ধূসর ভালবাসা

১.
প্রতিতির ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি পুরোপুরি,চোখ বোজা মেয়েটির মুখে মিস্টি মৃদু হাসি লেগে আছে .. সে চোখ খুলবে না ,স্বপ্ন হারাবার ভয়ে ,ভালোলাগার রেশটুকু আর কিছুক্ষণ থাকুক না!!

কিন্তু কপালে সুখ সইল না আর ,বদ্মাইশ আদিটা আচমকা পিঠে ঢাস করে চড় বসিইয়ে বললো " উঠ শালী ,হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বস " প্রতিতি ভাবে -এহ আসছে আমার আম্মা, ভাবটা এমন ,যেন পরীক্ষা শুধু আমার, তার নাই।
সে নীরবে উঠে বসে ,কিছুক্ষন আগের প্রেম প্রেম ভাবটা মুহুর্তেই গায়েব করে দিল কুটনিটা! !অসহ্য!!
এখন তাকে খুব সচেতন থাকতে হবে ,যেন কুটনি আদি কিছুতেই জানতে না পারে তার স্বপ্নের কথা ,তাহলে আর রক্ষা নাই।মুহুর্তেই পুরো হোস্টেল করে ছাড়বে!!
-অই , ভাব ধরে বসে আসিস ক্যান???যাহ উঠ বলতেসি!!
- আমি উঠে বসছি ,তুই আমাকে মেরে আবার দিব্বি শুয়ে আছিস বদ কোথাকার্।!!
প্রতি দাঁত মাজে আর হঠাৎ দেখে মুখটা হাসি হাসি .. কি আজব!! পাগল হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়।
কি অদ্ভুত সুন্দর একটা স্বপ্ন ,আর কি অসম্ভব সুন্দর সে চিত্রায়ন! যেন স্বপ্ন নয়, সত্যি।

এখনও ভাবছে আর লজ্জা পাচ্ছে .নিজেকে কেমন জানি বেহায়া লাগছে ওর!!যেন স্বপ্ন দেখার অধিকার টুকুনও নেই তার ..আর সেই মানুষ টিকে নিয়ে তোহ নয়ই!!
কিরে? !?!বই এর দিকে তাকায়ে তাকায়ে হাসিস ক্যান? !?!
আদিবার ডাকে ঘোর কাটে প্রতিতির --
এই রে! ধরা খেয়ে গেল বুঝি ..এখন তোহ নাছোড় বান্দা আদিটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া মুশকিল।

না মানে ভাবছিলাম যে --
--বল স্বপ্নে কি দেখসিস!!
_ওমা! স্বপ্নে কি দেখবো?! স্বপ্নই তোহ দেখিনি!!
-মিথ্যা বলিসনা প্রতি আমি বুঝি ,যাই হোক বিস্কুট নিয়া চা নিয়া আসি ,এসে শুনব ..

যাক বাবা ,একটু সময় পাওয়া গেল ,কিছু একটা ভেবে বের করতে হবে।
কিন্তু অন্য কিছুই ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা ,স্বপ্নের এক রত্তিও হারাতে মন চাইছে না।
হঠাৎই মনটা হু হু করে কেঁদে উঠে-
এই জীবনের পাওয়া না পাওয়াগুলো ভাবিয়ে তোলে ওকে , খুব সহজ সরল জীবনে পড়ালেখা আর ফ্যামিলি ছাড়া কিছু ভাবেনি ও .কিন্ত কেন আজ গ্র্যাজুয়েশনের শেষ পর্যায়ে এসে ধপ করে স্যার এর প্রেমে পড়বে সে?!?!
সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে সিনিয়র ব্যাচমেট জুনিয়র কত মানুষ ই কতভাবে কত কথা ইনিয়র বিনিয়ে বলল ,পাত্তা দেয়নি ,আর আজ কিনা এমন একজনের জন্যে ওর ....
আর ভাবতে চায়না ও ,পড়তে হবে ..দুইদিন পর এক্সাম ...

আদিবা ... প্রতির খুব ভাল বন্ধু আর রুমমেট ও ,শান্ত শিস্ট মেয়েটাকে অনেক বোঝার চেস্টা করেও বুঝতে পারেনা সে ..
অথচ প্রতি!!! আদিবার মনের কোণে একবিন্দু মেঘ জমলে দুমিনিট লাগেনা বুঝতে .. কি এক অদ্ভুত মায়া আর ভাল লাগা কাজ করে প্রতির জন্যে আদিবার ,আর দুঃখ হয়, মেয়েটাকে এক ফোটা বুঝতে না পারার দুঃখ।

গত কয়েক দিনে প্রতির পড়াশোনার ফাঁকে যে দু'দন্ড সময় মিলেছে ..সে সারাক্ষন স্যার কে ভেবেছে ..ব্যাপার টা লজ্জার ,আর ভয়ের্।

কাঊকে বলতে পারছে না।এটা কেমন কথা যে সে বলবে!! ডিপার্টমেন্টে স্যার গত দুমাস হল জয়েন করেছেন ,এসেই ক্লাসের অর্ধেক পোলাপান কে পাগল করেছেন। প্রতির ব্যাপার্টা শুরুতে ঠিক অমনটাই ছিল ,এমনি এমনি ভালো লাগতো ... এখন ব্যাপার টা আর এম্নি এম্নিতে নেই ,জল গড়িয়ে একাই বহু পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

আজ স্যার এর ক্লাস আছে।প্রতি খুব সকাল সকাল উঠে রেডি হচ্ছে ,আদি আধঘুম চোখে তাকিয়ে দেখছে হাসিখুশি প্রতিকে ,
-কিরে এতো মাঞ্জা মারিস ক্যান ক্লাসে যাইতে???
কোন পোলারে হ্যা কইরা দিলি???
- আরে অসভ্য তোর মত নাকি আমি??!মুখেমুখে এ কথা বললেও মনে মনে ঠিকই লজ্জ্বা পেয়ে গেল বেচারি .. যারে হ্যা করল সে তোহ জানেই না!!
-ক্লাসের শেষে ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল পোলাপান ,প্রতি আর আদিবাও জয়েন করলো ,যদিও রনো কে দেখে প্রতির ওখানে বসার ইচ্ছা ছিলনা ,তাও আদিবার জোড়াজুড়িতে বসলো ,
এই ছেলেটাকে দেখলেই ক্যান জানি মেজাজ খারাপ হয় ,দিন দুনিয়ার যত আজাইরা কাজে তার আগ্রহ ,আজাইরামির লিমিট থাকে এই পোলার তাও নাই।
বসেই মুড টা খারাপ হয়ে গেল ,আলোচনার মুল বিষয় হচ্ছে নতুন আসা স্যার!!! বিষয় - ব্যাটায় পাইসে কি??!সব মাইয়াগো লগে টাঙ্কি মারে? ?!!এর একটা ইমিডিয়েট একশন নেয়া দরকার্। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ন কাজ এটা ,আর বিহিত কর্তা একমাত্র রনো!!!

২.
রনো, অধীর আগ্রহে প্রতিতির অপেক্ষা ই করছিলো,প্রতিতির আসাটা আগেই আড় চোখে দেখে নিয়েছিলো আর টোপের মতই তখন থেকে স্যার এর কথা বলা শুরু করে দিয়েছিল অতি সুকৌশলে।এখন বুঝতে পারছে প্ল্যানটা ভালভাবেই খেটেছে।
আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক সে ঠিকি বুঝে, গত সাড়ে তিন বছরে এই মেয়ের খুব কাছে ঘেঁষতে না পারলেও এক মুহুর্তের জন্যে চোখের আড়াল হতে দেয়নি।কিন্তু কি জানি এক অদ্ভুত কারনে প্রতিতি ওকে সহ্য করতে পারেনা এটা বুঝতে পারলেও কারনটা আজও অজানাই রনোর।
প্রতিতিকে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস করতে পারেনি সে,
আর তাইতো অগোছালো জীবনটা অগোছালোই রয়ে গেল,প্রতিকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।কিন্তু আর যাই হোক প্রতি কে নিজের করতে না পারলেও, ও আর কারোর নয় এটাই যেন ওর শান্তি,একলা মেয়েটির একা পথচলা যেন রনোকে নির্ভার রাখতো। স্যার এর জন্যে প্রতির ভালোবাসায় সিক্ত চোখ যেদিন টের পেয়েছিলো, দেখতে ভীষন কষ্ট হয়েছে ওর।

কেন জানি ঠিক তখন থেকেই ভালোবাসার থেকে হিংসাটাই বেশি কাজ করেছে,
ও কষ্ট পায়, এখন প্রতি পাবে। মুহুর্তে
কি এক পৈশাচিক আনন্দ খেলে গেল রণ এর মাঝে প্রতির জোর করে আটকানো জল চিকচিক চোখ দুটো দেখে।
আদিবা-তোর আর কাজ নাই,স্যারের পিছে লাগছিস ক্যান?
রনো -আজ্জব!ব্যাটা পাইসে টা কি?!আর মাইয়া গুলাও যে এই বুড়ার মধ্যে কি পাইসে বুঝিনা!
প্রতির আর সহ্য হয়না,স্যার মোটেই বুড়া না!মুখ ফস্কে বলে উঠে
-তোদের মত অকর্মা না বলেই এতো আর্লি স্যার এই পরযায়ে আসছেন!!
রনো খুব অবাক হয়ে খেয়াল করলো প্রতিতি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বললো,এটা রেয়ার কেস!!
-এই আদিবা চল,দেরি হচ্ছে!

রনো চুপ করে যায় আর ভাবে,বেটা এমনেই পাত্তা দেয়না,তার উপর তোর কারনে পাত্তা পাওয়ার চান্সটারও পাত্তিনাশ হইলো,এর বিহিত করতেই হবে।

৩.
-অই,প্রতি।স্যার এর কথা শুনে এমন রিয়েক্ট করে চলে আসলি ক্যান???
আবার তুই স্যার এর প্রেমে পরস নাই তোহ??!!
-ধুর, তা ক্যান হবে।আমার অই আজাইরা পোলার আজাইরা প্যাচাল অসহ্য লাগতেসিল।
বিন্দু মাত্র রেসপেক্ট নাই ওর কারো প্রতি!
এই জন্যেই রাগ হয়েছে, আর আমাকে তোহ চিনিসই।
আর কথা বাড়ালোনা আদিবা,
কিন্তু রনোকে আদিবার খুব ভাল লাগে,প্রতি টা কেন যে ওকে দেখতে পারেনা,প্রতির যেমন গোছালো ছেলে পছন্দ তেমনি উল্টো আদির পছন্দে,রনোর মত আওলা ছেলে কে প্রথম দেখায়ই বেশ ভাল লেগেছিলো,শুরুর দিকে সখ্যতা থাকলেও প্রতির কারনে সম্পরকের বিস্তারন ঘটানো হয়নি।
প্রতিকে আদি একটু বেশিই ভালবাসে কিনা!!

৪.
ঘুম ভেংগে আজ আর প্রতি দেরি করলোনা, টিপ্টাপ হয়ে পড়তে বসে গেল,নেক্সট পরীক্ষা স্যার এর সাবজেক্ট, ভাল করতে হবে, কিন্তু কি করে পড়বে সে?!স্যার কে আজও স্বপ্নে দেখল,
স্যার বলল, ভয় পেয়োনা প্রতি,আমার হাত টা ধরে হাটো,পড়ে যেওনা যেন,প্রতি শক্ত করে হাতটা ধরলো!!!কি লজ্জা, কি লজ্জ্বা!!!!!!

আদিবা -কিরে বিলাই,ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসে গেলি যে!!ক্লাসে যাবিনা???!!
প্রেমিক পুরুষের ক্লাস আছে তোহ!!
প্রতি-না। যাবনা,তুই যা
(স্বপ্ন টা বড্ড মনে ধরেছে প্রতির,বাস্তবে স্যার কে দেখে এই ঘোর কাটাতে চায়না,বাস্তবে ছুঁয়ে দেবার অধিকার তার নেই,ভাল লাগা ঘোর টুকু সারাদিন তার সাথে থাকুক,কোথাও বেরুবেনা সে)

রনো আদিবা কে একা আসতে দেখল,
-কিরে কেমন আসস??তর খবর কি??জান কই???হেহে একলা ক্যান??তোরে এতিম এতিম লাগতেসে।
-এই তোহ চলে,সে আসেনাই,পড়তেসে।আমারে এতিম লাগলে তোর কি??
-না তোরে একলা মানায় না,পাশে আমার মত হ্যান্ডসাম কেউ থাকা উচিত!হা হা
(আদিবা মুহুর্তে চমকে যায়,এটা কি রনো শুধুই ফান করে বলল??!!! সেকি আদিবা কি চায় তা একটুও বুঝে)
-দোস্ত যাইগা।
-মানে কি?ক্লাস না করেই যাবিগা?!আসছিলি ক্যান!
-ঘুরতে,ঘুরা শেষ তাই যাইগা।

(প্রতি আসেনাই, খবর টা শোনার পর ওর রিয়েকশন দেখতে পারলে ভাল হতো,যাই হোক ফোন দেয়া যাক)

ফোনের রিং এ প্রতির ঘোর কাটল,বই এর পাতায় তাকিয়ে পুরো জগত ঘোরা শেষ!!
রনো কলিং...........
-হ্যালো,বল
-ক্লাসে আসলি না যে।
-এমনি,ফোন দিসিস ক্যান???
-না মানে,ভাবলাম ঠিক আসিস কিনা,
-হুম আছি।
-তোর স্যার আজ ক্লাস নিবেনা,না আইসা ভালই করসিস।
-আমার স্যার মানে?! তুই কি বলতে চাস??
-নাহ কিছুনা, স্যার এর ছেলে হইসে তোহ, এই আর কিহ।
-মানে কি?........
-কিছুনা, তোমার প্রেমকুমার আসলেই প্রেমিক পুরুষ, প্রেম করে বিয়ে করসিল ক্লাস মেট কে।
তাই ভাবলাম তোরেও অফার দেই,বুড়া হইলে আমারেও ওই বেটার মতই লাগবো,ভেবে দেখ,হাহাহা।
(ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ আওয়াজ নেই,তারপর পিত করে ফোন কেটে দেয়ার আওয়াজ শুনতে পেল রণো।)
নিজের অজান্তেই একটা মানুষ কে কতটা বেশি কষ্ট দিয়েছিল রনো তা বুঝেনি সেদিন।

অসম্ভব বাজে পরীক্ষা দিয়ে বের হল প্রতি,সে কিছুই বলতে পারেনি,যদিও তার প্রিপারেশন ভাল ছিল,এক্সটারনাল স্যার অনেক হেল্প করতে চাইলেন কিন্তু মেয়েটা কিছুই বললনা,দুবার স্যার এর দিকে তাকিয়ে ফের মাথা নিচু করে রইল।
বের হয়ে এসে অঝোরে কান্না,আদিবা সান্তনা দিচ্ছে,তুই তোহ ভাল,দেখবি ঠিক স্যার ভাল মার্ক দিবে,ঘাবড়ে গেসিলি হয়তো,।ফাইনাল দিয়ে যে যার মত বাড়ি গেল,রনোর সাথে প্রতিতিরআর দেখা না হলনা,শোনা হলনা রনোর রাত জাগা গল্প গুলোও।

৫.

২মাসের মাথায়,ফাইনালের রেজাল্ট হয়েছিল,সবাই পাশ করে গিয়েছিল,প্রতিতি সেই সাব্জেক্টে খুব ভাল মার্ক পেয়েছিল।
এখন প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় ওই সাব্জেক্টে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে,নাহ বিয়ে করেনি সে,কেন করেনি,তার কোন উত্তর নেই,যেন বাবা মার বিয়ে নিয়ে করা ইমোশনাল অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যেই তার এই দুর দেশে থাকা।

রনো একটা প্রাইভেট ফার্ম এ জব করছে,অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে আদিবার বাসা থেকে রনোর বাসায় প্রস্তাব গিয়েছে,রনো মানা করেনি।
যদি এই উসিলায় জীবনে প্রতির সাথে একবার দেখা হয়!!!

আদিবার ভীষন খুশি লাগছে,জীবনে সে যা চেয়েছে,তাই পেয়েছে,পাওয়ার খাতায় এখন রনোর নাম যোগ হতে যাচ্ছে,পাগলি প্রতি টা থাকলে খুব ভাল হতো,আদির বিয়েতে প্রতি থাকবেনা,এটাই আদির জীবনে বড় কষ্ট!!!!!

  • Facebook Comment